প্রবীর মিত্র, বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে চার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এফডিসিতে কাটিয়েছেন অসংখ্য শুটিং আর আড্ডার দিন।
সোমবার, জীবনের শেষ যাত্রায় এফডিসিতে এলেন তিনি। তবে এবার লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানে, নিথর মরদেহ। জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে এফডিসি ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিলেন এই গুণী অভিনেতা।
জানাজায় উপস্থিত ছিলেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও চলচ্চিত্রের বিভিন্ন পেশার মানুষ। চিত্রনায়ক আলমগীর, উজ্জ্বল, ইলিয়াস কাঞ্চন, মিশা সওদাগর থেকে বর্তমান প্রজন্মের ইমন, বাপ্পীরাও এসেছিলেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে।
জানাজার আগে, চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সংগঠন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় তাঁর কফিনে। পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর বড় ছেলে মিথুন বলেন, “আমার বাবার কোনো কথা বা আচরণে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে, দয়া করে তাঁকে ক্ষমা করবেন।” তিনি জানান, প্রবীর মিত্র বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাম রেখেছিলেন হাসান ইমাম।
শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর বলেন, “দাদা আমাদের মুরব্বি। সিনিয়রদের সম্মান করতে শিখিয়েছেন তিনি। সবাই তাঁর জন্য দোয়া করবেন।”
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “তিনি ছিলেন নিরহংকারী এবং অত্যন্ত বিনয়ী। কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে দেখিনি। তাঁর মতো মানুষ হারানো অপূরণীয় ক্ষতি।”
তাঁর মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চিত্রনায়ক বাপ্পী চৌধুরী। তিনি বলেন, “আজ সবাই তাঁকে দেখতে এসেছে। কিন্তু জীবদ্দশায় তাঁর খবর রাখিনি। আমরা ‘চলচ্চিত্র পরিবার’ বলি, কিন্তু সত্যিই কি তা মানি? প্রবীরদার মতো পথপ্রদর্শকরা একে একে চলে যাচ্ছেন। অগ্রজদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার সময় এখনই।”

নায়িকা রোমানা মুক্তি বলেন, “আমাদের শিল্পীদের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হওয়া উচিত। অসুস্থ হলে একে অন্যের পাশে থাকা জরুরি।”
এফডিসির পর প্রবীর মিত্রের দ্বিতীয় জানাজা হয় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে। বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
বাংলা চলচ্চিত্রের এই গুণী শিল্পী চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আজিমপুর কবরস্থানে। তাঁর স্মৃতি ও অবদান চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে চিরকাল অমলিন থাকবে।
[প্রবীর মিত্র] হারালাম একজন অমূল্য মানুষ
তারিক আনাম খান প্রবীর মিত্রকে স্মরণ করে বলেছেন, “প্রবীর মিত্র ছিলেন একজন অসাধারণ শিল্পী।” দৈনিক স্টার-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তরুণ বয়সে মিত্রের অভিনয়ে তিনি মুগ্ধ হতেন। “আমি তাঁর সিনেমা দেখতে হলে যেতাম। তাঁর অভিনয়ের যাদু আমাকে প্রতিবারই মুগ্ধ করত।”
দুজন একসঙ্গে কাজ করেছেন বহুবার, যদিও প্রকল্পগুলোর নাম তাঁর মনে নেই। তারিক আনাম খান বলেন, “এফডিসি এবং এর বাইরে বহুবার আমাদের দেখা হয়েছে। তাঁর হাসি ছিল এমন কিছু যা ভুলে থাকা অসম্ভব—সবসময় উষ্ণ, সবসময় আন্তরিক। এখনো চোখ বন্ধ করলে আমি সেই হাসি দেখতে পাই।”
প্রবীর মিত্র শুধু একজন অভিনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ভদ্র, সৎ এবং নম্র মানুষ। তারিক আনাম খান বলেন, “তিনি ছিলেন সত্যিকারের একজন ভদ্রলোক। এমন মানুষ খুব কমই দেখা যায়। তাঁর বিনয় ও সদয় স্বভাব সবাইকে মুগ্ধ করত।”
অভিনয়ে তাঁর নিষ্ঠা অতুলনীয় ছিল। “এমন প্রতিভাবান অভিনেতা খুব কমই পাওয়া যায়,” বলেন তারিক আনাম খান। “আমরা একজন সত্যিকারের অনন্য ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি।”
মিত্রের মানবিক গুণাবলীর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “প্রবীর দা কখনো রাগ করতেন না। কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। তাঁর ভালোবাসা ও সম্মানের মাধ্যমে সবাইকে আপন করে নিতেন।”
মৃত্যুর আগে প্রবীর মিত্র অসুস্থ ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তারিক আনাম খান বলেন, “জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি কষ্টে ছিলেন। আমাদের সিনিয়র শিল্পীরা প্রাপ্য সম্মান ও যত্ন পান না। এটি খুবই দুঃখজনক।”
তারিক আনাম খান শেষ কথা বলেন গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে। তিনি বলেন, “আমরা শুধু একজন মহান অভিনেতা নয়, একজন শিক্ষক, বন্ধু, এবং একজন অনুপ্রেরণাদায়ক মানুষকে হারিয়েছি। প্রবীর মিত্র ছিলেন এক এবং অনন্য। আমরা তাঁকে গভীরভাবে মিস করব।”
৮১ বছর বয়সে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে প্রবীর মিত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ছেলে সিফাত ইসলাম সংবাদটি নিশ্চিত করেন। ৪০০-রও বেশি ছবিতে অভিনয় করা এই গুণী শিল্পীর অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।